স্টাফ রিপোর্টার:
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় একই পরিবারের ৪ জনকে নৃশংস ভাবে জবাই করে হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে সি আই ডি পুলিশ। কলারোয়ার খলসি গ্রামে একই পরিবারের ৪ খুন (স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তান) এর ঘটনায় গ্রেফতারকৃত (নিহত শাহিনুর রহমানের ছোট ভাই) রায়হানুল ইসলাম (৩২) নৃশংস এই হত্যারকান্ডের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। মামলার তদন্ত কাজে নিয়োজিত সিআইডি’র কাছে রায়হানুল লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে।
আজ বুধবার বিকেলে সাতক্ষীরা সিআইডি অফিসে সিআইডি’র খুলনার অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক এক প্রেস ব্রিফিং-এ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান।
প্রেস ব্রিফিং-এ তিনি বলেন, রায়হানুল বেকার ছিল। কোন কাজ করতো না। এ কারণে গত জানুয়ারি মাসে রায়হানুল ইসলামের স্ত্রী বাপের বাড়িতে চলে যায়। এর পর থেকে ভাই-ভাবির সংসারে সে খাওয়া-দাওয়া করতো। রায়হানুল বেকার ছিলো বলে প্রায় তার ভাই, ভাবি গালমন্দ করতো ও বকাবাকি করতো। ঘটনার দিন গত ১৪ অক্টোবর আইপিএল খেলা দেখা নিয়ে ভাবি তাকে বকাবকি করে। ওই দিনই রায়হানুল সিদ্ধান্ত নেয় তার ভাবিকে সে হত্যা করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্ধ্যার পর স্থানীয় একটি দোকন থেকে “ডিসোফেন (২ এমজি)” ঘুমের ওষুধ কিনে কোমল পানির (স্প্রিট) সাথে মিশিয়ে কৌশলে রাতেই ভাবি ও দুই বাচ্চাকে খাইয়ে দেয়। এর পর রাতে ভাবি ও বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত দেড়টার দিকে তার বড় ভাই শাহিনুর রহমান বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরে দেখে রায়হানুল টেলিভিশন দেখছে। এতো রাত পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিল পুড়িয়ে কেন সে টেলিভিশন দেখছে তানিয়েও রায়হানুলকে বকাবকি করে ভাই শাহিনুর। এ সময় সে সিদ্ধান্ত নেয় শুধু ভাবিকে নয়, ভাইকেও সে হত্যা করবে। কৌশলে ভাইকেও ঘুমের ওষুধ মেশানো কোমল পানীয় খাইয়ে দেয়। এর পর রাত তিন টার দিকে বিল্ডিং-এর কার্নিশ বেয়ে ছাদে ওঠে। পরে ছাদের দরজা খুলে নীচের তলায় চলে আসে। প্রথমে সে তার ভাইকে চা-পাতি দিয়ে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যার পর তার পা বেধে ফেলে রেখে আসে। এর পর পাশের ঘরে প্রবেশ করে তার ভাবির গলায় চাপাতির কোপ দেয়। চাপাতির কোপে ভাবি চিৎকার করে উঠলে ছেলে-মেয়েরাও জেগে যায়। এর পর একে একে চার জনকেই কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করে। এর পর শিশুটিকে মৃত মায়ের পাশে রেখে সে বেরিয়ে যায়। হত্যার পর ভোরে প্রতিবেশিদের ডাকাডাকি করে।
সিআইডি কর্মকর্তা ওমর ফারুক সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আরো জানান, রায়হানুল ইসলামের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য তাকে বুধবার দুপুরে আদালতে পাঠানো হয়েছে। জবানবন্দি রেকর্ড প্রক্রিয়া চলছে। তিনি আরো বলেন, এই হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে আব্দুল মালেক নামের এক আসামীর ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছে। তবে রিমান্ড আবেদনের শুনানি হয়নি। এই হত্যাকান্ডের সাথে রায়হানুল ছাড়া আর কেউ জড়িত কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, আমরা তদন্তে এখনো পর্যন্ত যতোটুকু উদ্ধার করতে পেরেছি তাতে এই হত্যাকান্ডের সাথে রায়হানুল ইসলাম ছাড়া আর কেউ জড়িত নয়। তবে তদন্ত শেষ হয়নি। আরো তথ্য উদঘটনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। রায়হানুলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী বাড়ির পাশ্ববর্তী পুকুর থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহ্নত একটি চা-পাতি উদ্ধার করা হয়েছে।
এছাড়া প্রেস ব্রিফিং এ সিআইডি সাতক্ষীরার বিশেষ পুলিশ সুপার আনিছুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি সন্ধ্যায় জানান, আসামী রায়হানুলের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি রেকর্ড কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। আদালতেই সে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ অক্টোবর ভোর রাতে কলারোয়া উপজেলার হেলাতলা ইউনিয়নের খলসি গ্রামের শাহাজান আলীর ছেলে মৎস্য হ্যাচারী মালিক শাহিনুর রহমান (৩৮), তাঁর স্ত্রী সাবিনা খাতুন (৩৫), ছেলে সিয়াম হোসেন মাহী (৯) ও মেয়ে তাসনিম সুলতানা (৬) কে জবাই করে হত্যা করে দূর্বৃত্তরা। এ সময় নারকীয় এই হত্যাকান্ডের মধ্যে ঘাতকদের হাত থেকে জীবনে বেঁচে যায় তাদের ৪ মাসের শিশু কন্যা মারিয়া সুলতানা। শিশুটি বর্তমানে হেলাতলা ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা ইউপি সদস্য নাসিমা খাতুনের হেফাজতে রয়েছে।
এ ঘটনায় নিহত শাহিনুরের শ্বাশুড়ি ময়না খাতুন বাদি হয়ে কারো নাম উল্লেখ না করে কলারোয়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি রুজুর পর থেকেই তদন্ত ভার নেয় সিআইডি।
এ ঘটনার একদিন পর সিআইডি নিহত শাহিনরের ভাই রায়হানুলকে গ্রেফতার করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত রোববার আদালত থেকে তাকে ৫ দিনের রিমান্ড নেয়া হয়।
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে এই হত্যা মামলায় আরো তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। এরা হলো খলসি গ্রামের আব্দুস সামাদের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (২৮), আবুল কাশেমের ছেলে আব্দুল মালেক (৩৫) ও আসাদুল ইসলাম (২৭)। এদের মধ্যে রাজ্জাক ও মালেক নিহত শাহিনুরের নিকট প্রতিবেশি এবং আসাদুল ইসলাম নিহত শাহিনুরের হ্যাচারির কর্মচারী বলে জানাগেছে।